শেষ মুহূর্তে সেরা ট্যাক্স রেয়াত: কোথায় বিনিয়োগ করবেন? (আয়বর্ষ ২০২৪-২০২৫)

আয়কর বর্ষ প্রায় শেষের দিকে, আর এই সময়ে অনেক করদাতাই চিন্তিত থাকেন কিভাবে তাদের করের পরিমাণ কমানো যায়। সঠিক পরিকল্পনা এবং শেষ মুহূর্তের কিছু স্মার্ট বিনিয়োগের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আয়কর রেয়াত (Tax Rebate) পাওয়া সম্ভব। এই আর্টিকেলে আমরা আলোচনা করব বাংলাদেশে আয়কর রেয়াত পাওয়ার জন্য সেরা কিছু বিনিয়োগের ক্ষেত্র নিয়ে, বিশেষ করে যারা এখনও এই সুযোগগুলো কাজে লাগাননি তাদের জন্য।

গুরুত্বপূর্ণ: এই আর্টিকেলটি ৩০শে জুন, ২০২৫ এর মধ্যে বিনিয়োগ করে ২০২৪-২০২৫ আয়বর্ষের জন্য রেয়াত পাওয়ার উদ্দেশ্যে লেখা। ট্যাক্স আইন পরিবর্তনশীল, তাই সর্বশেষ তথ্যের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (NBR) এর ওয়েবসাইট বা একজন অভিজ্ঞ ট্যাক্স উপদেষ্টার পরামর্শ নিন। এই আর্টিকেলে প্রদত্ত কিছু তথ্য ব্যবহারকারীর সরবরাহকৃত উৎসের (taxhishab.com) উপর ভিত্তি করে আপডেট করা হয়েছে।

আয়কর রেয়াত কী এবং এটি কিভাবে কাজ করে?

আয়কর রেয়াত হলো করযোগ্য আয়ের উপর সরকার কর্তৃক অনুমোদিত কিছু নির্দিষ্ট খাতে বিনিয়োগ বা ব্যয়ের বিপরীতে প্রদেয় আয়করের উপর ছাড়। এর ফলে আপনার মোট প্রদেয় আয়করের পরিমাণ কমে আসে। সাধারণত, আপনার মোট আয়ের একটি নির্দিষ্ট শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ রেয়াতের জন্য যোগ্য বিবেচিত হয় এবং তার উপর নির্দিষ্ট হারে রেয়াত পাওয়া যায়।

বাংলাদেশে, রেয়াতযোগ্য বিনিয়োগের মোট পরিমাণ করযোগ্য আয়ের ২৫% বা ১ কোটি টাকা বা প্রকৃত বিনিয়োগ – এই তিনটির মধ্যে যেটি কম, তার বেশি হতে পারে না। এই অনুমোদিত বিনিয়োগের উপর সাধারণত ১৫% হারে রেয়াত পাওয়া যায় (যদি করযোগ্য আয় ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত হয়, অন্যথায় ১০%)।

আপনার সর্বোচ্চ কত টাকা রেয়াত পেতে পারেন তা জানতে আমাদের ট্যাক্স রেয়াত ক্যালকুলেটর ব্যবহার করতে পারেন।

শেষ মুহূর্তে বিনিয়োগের জন্য সেরা কয়েকটি ক্ষেত্র

সময় যেহেতু কম, তাই এমন কিছু খাতে বিনিয়োগ করা উচিত যেখানে দ্রুত এবং সহজে বিনিয়োগ করা যায় এবং যা আয়কর আইনে রেয়াতের জন্য স্বীকৃত। নিচে কয়েকটি জনপ্রিয় স্কিম আলোচনা করা হলো:

১. সঞ্চয়পত্র (Sanchayapatra)

সঞ্চয়পত্র বাংলাদেশ সরকারের একটি জনপ্রিয় এবং নিরাপদ বিনিয়োগ মাধ্যম। বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্র রয়েছে, যেমন: ৫-বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, পরিবার সঞ্চয়পত্র, পেনশনার সঞ্চয়পত্র ইত্যাদি। এগুলোতে নির্দিষ্ট মেয়াদে নির্দিষ্ট হারে মুনাফা পাওয়া যায় এবং এই বিনিয়োগ আয়কর রেয়াতের জন্য যোগ্য।

(তথ্যসূত্র: জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর, বাংলাদেশ ব্যাংক, এবং ব্যবহারকারী কর্তৃক সরবরাহকৃত তথ্যসূত্র)

২. ডিপোজিট পেনশন স্কিম (DPS)

ডিপোজিট পেনশন স্কিম (ডিপিএস) একটি মাসিক সঞ্চয় প্রকল্প যা ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে খোলা যায়। প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা দিয়ে মেয়াদ শেষে একটি ভালো অঙ্কের টাকা পাওয়া যায়।

৩. জীবন বীমা (Life Insurance)

জীবন বীমা পলিসি একটি সুরক্ষা এবং একইসাথে বিনিয়োগের মাধ্যম। জীবন বীমার প্রিমিয়ামও আয়কর রেয়াতের জন্য যোগ্য।

৪. শেয়ার বাজার বা স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ

তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড বা ডিবেঞ্চারে বিনিয়োগ করেও আয়কর রেয়াত পাওয়া যায়। তবে এটি বাজার ঝুঁকির সাথে সম্পর্কিত।

৫. প্রভিডেন্ট ফান্ড (PF) ও অনুমোদিত ভবিষ্যৎ তহবিল

৬. যাকাত (Zakat)

সরকার অনুমোদিত যাকাত ফান্ডে যাকাত প্রদান করলে সেই পরিমাণ অর্থ আয়কর রেয়াতের জন্য বিবেচিত হয়।

(তথ্যসূত্র: যাকাত ফান্ড (ব্যবস্থাপনা) আইন, ২০২৩)

৭. অন্যান্য অনুমোদিত খাত

এছাড়াও সরকার কর্তৃক অনুমোদিত আরও কিছু খাত রয়েছে যেখানে বিনিয়োগ বা দান করলে আয়কর রেয়াত পাওয়া যায়, যেমন:

এইসব ক্ষেত্রে দানের স্বপক্ষে উপযুক্ত প্রমাণপত্র (যেমন, রসিদ) দাখিল করতে হয়।

বিভিন্ন স্কিমের তুলনামূলক সারণী (শেষ মুহূর্তের জন্য)

বিনিয়োগের খাত ঝুঁকির মাত্রা তারল্য (Liquidity) বিনিয়োগের সহজলভ্যতা (শেষ মুহূর্তে) বার্ষিক রেয়াতযোগ্য সীমা (সাধারণভাবে)
সঞ্চয়পত্র খুব কম মেয়াদান্তে বা নির্দিষ্ট শর্তে ভাঙানো যায় সহজ (ব্যাংক/পোস্ট অফিস) বার্ষিক ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত (মোট অনুমোদিত বিনিয়োগের অংশ)
ডিপিএস কম মেয়াদান্তে বিদ্যমান থাকলে প্রিমিয়াম জমা সহজ বার্ষিক ১,২০,০০০ টাকা পর্যন্ত
জীবন বীমা কম মেয়াদান্তে বা সারেন্ডার ভ্যালু সহজ (এজেন্ট/অনলাইন) পলিসি মূল্যের ১০% পর্যন্ত প্রিমিয়াম
শেয়ার বাজার বেশি বেশি (বাজার চালু থাকলে) BO অ্যাকাউন্ট থাকলে দ্রুত মোট অনুমোদিত বিনিয়োগের অংশ
প্রভিডেন্ট ফান্ড খুব কম চাকরির শেষে বা নির্দিষ্ট শর্তে সাধারণত মাসিক কর্তন প্রদত্ত চাঁদা ও সুদ (শর্ত সাপেক্ষে)
যাকাত (অনুমোদিত ফান্ডে) নেই (দান) নেই (দান) সহজ প্রকৃত প্রদত্ত অর্থ

শেষ মুহূর্তের বিনিয়োগ কৌশল

  • দ্রুত সিদ্ধান্ত নিন: সময় যেহেতু কম, তাই বেশি বিশ্লেষণ না করে পরিচিত এবং সহজে বিনিয়োগযোগ্য স্কিমগুলো বেছে নিন।
  • প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত রাখুন: জাতীয় পরিচয়পত্র, টিআইএন সার্টিফিকেট, ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য ইত্যাদি প্রস্তুত রাখুন।
  • অনলাইন সুবিধা ব্যবহার করুন: অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এখন অনলাইনে বিনিয়োগ বা প্রিমিয়াম জমা দেওয়ার সুযোগ দেয়।
  • বিনিয়োগের প্রমাণ রাখুন: বিনিয়োগের রসিদ, সার্টিফিকেট বা চালানপত্র সাবধানে সংরক্ষণ করুন, যা রিটার্ন দাখিলের সময় প্রয়োজন হবে।
  • আয়কর উপদেষ্টার পরামর্শ: যদি জটিলতা মনে হয় বা বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করতে চান, তাহলে একজন অভিজ্ঞ আয়কর উপদেষ্টার পরামর্শ নিতে পারেন।

আপনার মোট কর রেয়াত গণনা

আপনার মোট করযোগ্য আয় এবং অনুমোদিত খাতে মোট বিনিয়োগের উপর ভিত্তি করে আপনি কত টাকা কর রেয়াত পাবেন, তা গণনা করা একটু জটিল হতে পারে। এই গণনার জন্য, আপনি আমাদের আয়কর ক্যালকুলেটর এবং সর্বোচ্চ রেয়াত ক্যালকুলেটর ব্যবহার করতে পারেন। এই ক্যালকুলেটরগুলো আপনাকে সম্ভাব্য রেয়াতের পরিমাণ সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা দেবে।

অন্যান্য বিবেচ্য বিষয়

শুধুমাত্র কর রেয়াত পাওয়ার জন্য হুট করে যেকোনো খাতে বিনিয়োগ করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বিনিয়োগের আগে কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করা উচিত:

উপসংহার

আয়কর বর্ষের শেষ মুহূর্তে হলেও, সঠিক পরিকল্পনা ও দ্রুত পদক্ষেপের মাধ্যমে ট্যাক্স রেয়াতের সুবিধা নেওয়া সম্ভব। উপরে আলোচিত খাতগুলো ছাড়াও আরও কিছু অনুমোদিত খাত রয়েছে। আপনার জন্য কোনটি সবচেয়ে উপযুক্ত, তা আপনার ব্যক্তিগত আর্থিক অবস্থা ও লক্ষ্যের উপর নির্ভর করবে। তবে মনে রাখবেন, শুধুমাত্র কর বাঁচানোর উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ না করে, আপনার সামগ্রিক আর্থিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিনিয়োগ করা উচিত।

তথ্যসূত্র ও প্রয়োজনীয় লিঙ্ক (সাধারণ তথ্যের জন্য):

এই আর্টিকেলের তথ্য শুধুমাত্র সাধারণ নির্দেশনার জন্য। আইনগত বা আর্থিক বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সর্বদা একজন যোগ্য পেশাদারের সাথে পরামর্শ করুন। সর্বশেষ আপডেট এবং বিস্তারিত তথ্যের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট দেখুন। (৩০শে মে, ২০২৫ অনুযায়ী তথ্য)